ফিফা ও উয়েফার কপালে চিন্তার ভাঁজ। যে গুঞ্জনটা শোনা যাচ্ছিল অনেকদিন ধরে, ২০০৯ সালে আর্সেন ওয়েঙ্গার প্রকাশ করেছিলেন শঙ্কা, তবে এই লম্বা সময়ে আর কিছুই শোনা যায়নি। ভেতরে ভেতরে নাকি জোট বাঁধছে নামেধামে ভারী ক্লাবগুলো। ভেতরের কথা অবশেষে বাইরে এলো, সত্যির পথে ফুটবলের ঐক্য ভাঙ্গার গুঞ্জন। অর্থ আর দাপটের অপ্রাপ্তিতে ভুগতে থাকা ইউরোপের জায়ান্ট ১২ ক্লাব মিলে দিয়েছেন নতুন টুর্নামেন্ট আয়োজনের ঘোষণা। ইউরোপিয়ান সুপার লিগ (ইএসএল)।
কারা কারা থাকছে: ইপিএলের বিগ সিক্স অর্থাৎ আর্সেনাল, চেলসি, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার সিটি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও টটেনহ্যাম হটস্পারের সাথে লা লিগা থেকে যুক্ত হবে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও আতলেতিকো মাদ্রিদ, সিরি-আ থেকে ইউভেন্তুস, এসি মিলান ও ইন্টার মিলান। এই বারো দলের সাথে যুক্ত হবে আরও ৩ দল, মোট ১৫ দলে কোনো পরিবর্তন আসবে না, অর্থাৎ যতো কিছুই হোক টুর্নামেন্টের তারা স্থায়ী সদস্য। টুর্নেমেন্টে পারথমিক চুক্তি ২৩ বছরে, এই প্রায় ২ যুগে টুর্নামেন্টের ক্ষমতা এবং চাবি থাকবে তাদের হাতেই।
কোয়ালিফায়ার পদ্ধতি: টুর্নামেন্টের ১২ দলের সাথে ৩ দল অর্থাৎ মোট ১৫ দলের বাইরে থেকে বাছাই পর্বের মাধ্যমে যুক্ত হবে আরও ৫ দল। মোট ২০ দল নিয়ে হবে লিগ। দুটো গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে দলগুলো। গ্রুপের সেরা তিন দল সরাসরি খেলবে কোয়াটার ফাইনাল। গ্রুপের চতুর্থ এবং পঞ্চম দল খেলবে কোয়ালিফায়ার ম্যাচ। গ্রুপের ম্যাচগুলো হবে হোম এবং অ্যাওয়ে, ফাইনাল হবে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে।
ইএসএলের বক্তব্য: ‘যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়নযোগ্য’ এই পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে ইএসএল ম্যানেজম্যান্ট। ইউএসএলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেসকে। ইএসএল থেকে জানানো হয়েছে, ফুটবলের স্বার্থেই কাজ করবেন তারা। ফুটবলকে দুনিয়ার একমাত্র বৈশ্বিক খেলা আখ্যা দিয়ে ইউসিএল থেকে জানানো হয়েছে দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণই তাদের মূল উদ্দেশ্য।
গণমধ্যামের বিশ্লেষণ: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মূল খবরই এখন ইএসএল। টুইটারে ট্রেন্ডিংয়েও নাম্বার ওয়ান। গণমাধ্যমগুলো বলছে যতই দর্শক স্বার্থের কথা বলা হোক, ইউরোপের ১২ ক্লাবের এই জোটের পেছনের এবং মূল কারণ অর্থ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে যে পরিমান অর্থ আসে তা ক্লাবগুলোর চাহিদার চেয়ে কম, নতুন টুর্নামেন্টে অর্থ প্রাপ্তির সম্ভাবনা ঢের বেশি। জানা গেছে, আমেরিকান কোম্পানি জে.পি. মরগ্যান প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেতে যাচ্ছে ইএসএলে। হিসেব অনুযায়ী টুর্নামেন্টে অংশ নিলেই দলগুলো পাবে ৫০০ মিলিয়ন ইউরো। এছাড়া টিভি স্বত্ত থেকেও অর্থ প্রাপ্তির রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা।
দর্শকদের জন্য কি শুধুই হতাশা?: প্রথমেই বলা হয়েছে ফুটবলের ঐক্য ভাঙ্গার মঞ্চ। সাধারণ দর্শকদের তো আর অর্থের চাহিদা নাই তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের জন্য এমন উদ্যেগ হতে পারে হতাশার। তবে শুধু হতাশা না, ক্লাব রাজনীতি বাদ দিলে থাকছে দর্শকদের উপভোগের দারুণ মঞ্চ। এই যেমন প্রিমিয়ার লিগে ফুটবল দাপট আর ফ্যানবেজ কোনো কিছুরই কমতি নাই, কিন্তু ইউরোপ সেরার মঞ্চে নিয়মিত না আর্সেনাল। হয়তো অনেক কিছুই একসাথে ফিরবে ইএসএলে। নিয়মিতই হয়তো দেখা হবে বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের; নির্দিষ্ট করে বলে হ্যাবিওয়েট সব ক্লাশের। তবে কথায় আছে সবকিছু সহজলোভ্য হলে মূল্য থাকে না। এখন দেখা যাক, কিছু প্রশ্নের উওর সময়ের কাছেই তোলা থাক।
কেনো নেই জার্মান কোনো ক্লাব?: জামার্নির কোনো ক্লাবের প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানা ৪৯ শতাংশ। ক্লাবের ব্যাপারে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয় তবে প্রয়োজন হবে দর্শকদদের ভোটের। তাই বায়ার্ন মিউনিখ বা বরুশিয়া ডর্টমুন্ড কারো জন্যই কাজটা সহজ না। তবে সময়ের পরিক্রমায় বদলে যেতে পারে অনেক কিছু।
ফিফা আর উয়েফার বক্তব্য: ইএসএলের পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনায় ফিফা আর ইউয়েফা। শুধু ফিফা আর ইউয়েফা না, ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন থেকেও করা হয়েছে কড়া বিরোধিতা। ইংলিশ এফএ, লা লিগা ও সিরি আ কমিটিও আবেদন করেছে ক্লাবগুলোকে এই টুর্নামেন্টে না যাওয়ার জন্য। এছাড়া উঠেছে নিষিদ্ধের দাবিও। ফিফার মতে এমন টুর্নামেন্ট নষ্ট করবে ফুটবলের টেম্পারম্যান্ট। ইউয়েফা কর্তৃপক্ষ প্রকল্পকে সরাসরি আখ্যা দিয়েছে ‘জঘন্য’ বলে। এছাড়া বিশ্বকাপ থেকে ইএসএল খেলা ফুটবলারকে ছেঁটা ফেলা হতে পারে বলে জানিয়েছে ফিফা।
Plans for a European Super League would be very damaging for football and we support football authorities in taking action.
They would strike at the heart of the domestic game, and will concern fans across the country. (1/2)
— Boris Johnson (@BorisJohnson) April 18, 2021
Today I wake up to crazy news! ? An insult to my belief: football is happiness, freedom, passion, fans and is for everyone. This project is disgusting, not fair and I’m disappointed to see clubs I represented involved. Fight against this! ??❤️⚽️ #StopTheSuperLeague
— Lukas-Podolski.com (@Podolski10) April 19, 2021
টুইট আর সমালোচনা: ইএসএলের ঘোষণা শুধু ফুটবল না আলোড়ন তুলেছে ফুটবলের বাইরেও। এই যেমন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন টুইটে সমালোচনা করেছেন এমন আয়োজনের। শুধু বরিস জনসন না ইউএসএল নিয়ে আলাদা বক্তব্যে পৃথীবীর নানা প্রান্তের পরিচতি ব্যক্তিত্ব করেছেন সমালোচনা, জানিয়েছেন নিন্দা। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক ডিফেন্ডার গ্যারি নেভিল এই পরিকল্পনাকে বেঈমানী আখ্যা দিয়ে কেবলই ক্লাবগুলোত লোভ বলে মন্তব্য করেছেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এমন টুর্নামেন্ট আয়োজনের খবরের পর ইউরোপিয়ান ক্লাব অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। যদিও শীর্ষস্থানীয় একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ধারণা সেই বৈঠকে ১২ ক্লাবের কেউই উপস্থিত ছিল না। অর্থাৎ কোনো কিছুকেই তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না ক্ষমতার মোহে আবৃত ক্লাবগুলো। ফুটবলের ঐক্য ভাঙ্গার মঞ্চ প্রস্তুত। দর্শক হিসেবে আপনি প্রস্তুত-তো?