১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল, আমার একমাত্র বোনের বয়স তখন মাত্র ৭ বছর। বাবা থাকেন মালয়েশিয়ায়। সেই ৭ বছর বয়সী বোনকে সঙ্গে নিয়ে মা সেদিন ছিলেন ঢাকার পথে। কিন্তু কে জানতো, বাংলা নববর্ষের ঠিক আগের দিন রঙিন উল্লাসে সয়লাব হবে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া?
বাসে থাকা আমার মা সেদিন বোনকে নিয়ে সাক্ষী হয়েছিলেন এক অদ্ভুত সুন্দর উপলক্ষের। চারদিকে রঙ ছোড়াছুড়ি, ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উল্লাস করেছিল অফিসের বড় কর্তা থেকে শুরু করে রিক্সা চালক, চা-বিক্রেতা সব পেশার মানুষ।
২৪ বছর আগের সেই দিনটা এতই রোমাঞ্চকর ছিল যে, আজ প্রায় দুই যুগ পরেও আমার মা সেদিনের গল্প বলতে গিয়ে স্মৃতি বিভোর হয়ে উঠেন।
‘এবং বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি ১৯৯৭ সালের চ্যাম্পিয়ন’ বাংলাদেশ বেতারে ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফর উল্লাহ শারাফাত যখন চিৎকার করে সেদিন এই লাইন বললেন ততক্ষণে অবশ্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে গোটা দেশের মানুষ। জয়সূচক রান নেবার পর হাসিবুল হোসেন শান্তর সঙ্গে সেদিন ছুটেছিল গোটা বাংলাদেশ।
বিখ্যাত স্কটিশ যোদ্ধা রবার্ট থে ব্রুস তার সপ্তম প্রচেষ্টায় সফল হয়েছিলেন, বাংলাদেশ দলের সেবার ছিল ষষ্ঠ আইসিসি ট্রফি। বারবার তীরে এসে তরী ডুবানো লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের জন্য ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি ছিল নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। আসরের দ্বিতীয় রাউন্ডে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ১৭২ রানের সহজ লক্ষ্য টাইগারদের জন্য সেদিন হয়ে উঠেছিল বড্ড কঠিন।
লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ১৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে আরেকটি স্বপ্নভঙ্গের গল্প রচনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। তবে বৃষ্টি, রোদ্দুর, ডাচ শিবির আর টাইগারদের চতুর্মুখী লড়াইয়ে মাঝে ব্যক্তিগত ৬৮ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে সেমি-ফাইনালের টিকিট এনে দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের খান পরিবারের ছেলে আকরাম খান।
চট্টলার আকরাম থেকে পদ্মা পাড়ের খালেদ মাসুদ পাইলট, সেমি-ফাইনালে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে স্বপ্নের বিশ্বকাপ নিশ্চিত হবার দিন পাইলট খেলেছিলেন ৭০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। দিনটি ছিল ৯ এপ্রিল, একটি সাধারণ দিন সেদিন হয়ে উঠেছিল অসাধারণ। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায়। তবে তারা কি সেদিন জানতো ‘বেস্ট ইজ ইয়েট টু কাম’?
দেশের মানুষ হয়তো বিশ্বকাপ নিশ্চিত হবার গৌরবেই বাংলাদেশ দলকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত ছিল। তবে পাইলট-আকরামদের মস্তিষ্ক জুড়ে ছিল চ্যাম্পিয়ন হবার স্বপ্ন। ১২ই এপ্রিল ছিল সেই স্বপ্ন পূরণের দিন। কোনো ইতিহাস গড়ার পথই সহজ নয়। আইসিসি ট্রফির শিরোপা নিশ্চিতের দিনটিও খুব সহজ ছিল না বাংলাদেশের জন্যে।
কুয়ালালামপুরে সেদিন স্টিভ টিকোলোর ব্যাট কথা বলেছিল কড়া ভাষায়। তার ১৪৭ রানের অনবদ্য ইনিংসে শুরুর ব্যর্থতা জয় করে ৭ উইকেটে ২৪১ রানের পুঁজি পায় প্রতিপক্ষ কেনিয়া। তবে বৃষ্টি বাধায় দীর্ঘায়ীত হয় ‘ইনিংস ব্রেক’। খেলা গড়ায় রিজার্ভ ডে’তে।
পরেরদিন সকাল সাতটায় শুরু হবার কথা ছিল খেলা। গোটা জাতি গুনছিল অপেক্ষার প্রহর। নির্ধারিত সময় রেডিওতে কান পাতলো সবাই, তবে যেখানে তাদের অপেক্ষা ছিল আকরাম- নান্নুদের ব্যাট-বলের হুংকার শোনার, সেখানে তারা শুনলো চৌধুরী জাফর উল্লাহ শারাফাতের মনমরা কণ্ঠস্বর। আগের দিনের বৃষ্টিতে মাঠ এখন খেলা হবার মতো পরিস্থিতিতে নেই।
ইতিহাস বলে বাঙ্গালীকে কেউ কখনো দাবায় রাখতে পারেনি। সেদিন মনমরা ঢাকা,রাজশাহীসহ প্রার্থনারত গোটা বাংলাদেশ, আর শত মাইল দূরে প্রবাসী বাংলাদেশি থেকে শুরু করে মিডিয়া কর্মী, দলের সদস্য এমনকি তৎকালীন বোর্ড প্রধান সাবের হোসেন চৌধুরী, অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদির অবিশ্বাস্য সাধনে আবার মাঠে গড়ায় খেলা।
দুপুর দেড়টায় শুরু হয় খেলা। ২৫ ওভারে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৬৬। টি-টোয়েন্টির যুগে পা দেয়ার আগে এমন লক্ষ্যকে কঠিন না বলা ছাড়া উপায় ছিল না। লক্ষ্য আরও কঠিন হয়ে যায় যখন ইনিংসের প্রথম বল প্যাভিল্যনের পথ ধরেন ওপেনার নাঈমুর রহমান দুর্জয়। তবে ছোট ছোট ইনিংসে চাপ সামলে এগুতে থাকে বাংলাদেশ। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৬ উইকেটে ১২৩ রান।।
জয় কঠিন হতে থাকে, ডাগ আউটে বাড়তে থাকে হতাশা। কখনো মাথা নিচু করে নখ কামড়ানো আবার কখনো মুখ চেপে ধরে দাড়িয়ে থাকা ক্রিকেটার, স্টাফ, সংগঠক থেকে সমর্থক সেই মূহুর্তে সবার পরিচিত দৃশ্য ছিল এটি।
শেষ ওভারে দরকার ১১ রান। হাতে কেবল দুই উইকেট। স্বীকৃত ব্যাটসম্যান কেবল পাইলট, উইকেটের অপর প্রান্তে হাসিবুল হাসান শান্ত। মার্টিন সুজির প্রথম বলটি মিড অনের উপর দিয়ে পাইলট পাঠালেন সীমানার বাইরে। স্বপ্ন হারানোর গল্পের শেষে দাঁড়িয়ে আবার নতুন স্বপ্নে বিভোর হলো গোটা জাতি।
শেষ চার বলে প্রয়োজন ছিল ৫ রান। সেখান থেকে শেষ বলে ১ রান নিলেই চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। স্ট্রাইকে ছিলেন হাসিবুল হাসান শান্ত। শেষ বলটি শান্তের প্যাডে লেগে লেগ গালি অঞ্চলে থাকা ফিল্ডারের হাতে পৌঁছানোর আগেই দুই হাত উঁচু করে বুনো উল্লাসে মেতে উঠেন পাইলট। দুই হাত উঁচু করে কাঙ্ক্ষিত রানটি সম্পন্ন করে জানান দেন, বাংলাদেশ এখন আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন। জয়ের অপেক্ষায় বিভোর একটা দেশ মুহূর্তে বনে যায় উৎসবের জনপদ।
বাংলাদেশ বেতারে ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফর উল্লাহ শারাফাতের চিৎকার, টিভিতে হার্শা ভোগলের কণ্ঠে শোনা গেল, ‘বাংলাদেশ আর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স। ওয়ান সিক্সটি সিক্স ফর এইট, দ্যাট ওয়াজ দেয়ার টার্গেট এন্ড দে হেভ গট দেয়ার। হোয়াট এ ডে ফর দেয়ার হিস্ট্রি, নট অনলি ফর বাংলাদেশ ক্রিকেট বাট অফ অ্যা ন্যাশন দ্যাট ইজ এক্সেটলি টোয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স অফ ওল্ড।‘
আমাদের পরিবারের সাথে জেদ করে প্রথম ব্যাটের গল্প যেমন পুরনো হয় না, ঠিক তেমন পুরনো হবে না বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জয়ের গল্প। ঐতিহাসিক সেই জয়ের পরে বিশ্বকাপে আমরা পাকিস্তানকে হারিয়েছি, টেস্ট জিতেছি, ঘরে তুলেছি ছোটদের বিশ্বকাপ। এই এতসব সাফল্যের ভীত কিন্তু রচিত হয়েছিল ওই ১৩ এপ্রিল, এই ১৩ এপ্রিল…………….