১৫ মার্চ ২০২৫, শনিবার

চেনা গল্পে অচেনা সাকিব

- Advertisement -

পনেরো বছর পেরোতে চলেছে জাতীয় দলের জার্সিতে, ষোলতে পা দেয়ার অপেক্ষায় সাকিব আল হাসান। বয়সটাও পয়ত্রিশ প্রায়, সময় এসেছে ক্রিকেটে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার। ছোট্ট এই বাংলাদেশ থেকে হয়েছেন বিশ্বসেরা, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন যে সঠিকভাবেই করতে জানেন সেটা অস্বীকার করার তাই কোনোই উপায় নেই। ইতোমধ্যে যে নতুন পরিকল্পনায় পথচলাও শুরু করে দিয়েছেন, নিউজিল্যান্ড সফরে না থাকা সেই বার্তাই দেয়।

বাংলাদেশ দল নিউজিল্যান্ডে, দেশসেরা ক্রিকেটার পরিবারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে; জানিয়েছেন একইভাবে এগোবে গল্প, দৃশ্যপটে আসবে না পরিবর্তন। অর্থ্যাৎ, বেছে বেছে খেলবেন ক্রিকেট; অপ্রয়োজনীয় ম্যাচগুলোতে আগ্রহ নেই অংশগ্রহণের। এমনকি দেশ ছাড়ার আগে জানিয়ে গিয়েছেন যেকোনো একটা ফরম্যাট থেকে অবসরের ভাবনাও! সেইসাথে চিরকাল বলে আসা প্রিয় ফরম্যাট ‘টেস্ট’ নিয়েও নাকি সময় এসেছে ভাবার!

“সময় এসেছে আমার টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করার। আমি টেস্ট খেলব কি খেলব না। আর যদি খেলি তাহলেও কিভাবে খেলব। আমি বলছি না আমি টেস্ট থেকে অবসরই নিয়ে নেব। এমনও হতে পারে আমি টি-টোয়েন্টি খেলা ছেড়ে দিলাম ২০২২ বিশ্বকাপের পর; শুধু টেস্ট ও ওয়ানডে খেললাম। তবে তিন ফরম্যাটে একসাথে খেলা অসম্ভবের কাছাকাছি। আমার কাছে আর কোন পথ খোলা নেই।”

বাংলাদেশের ম্যাচ আর সাকিব থাকবেন না? এভাবে ভাবলে হয়তো মন খারাপ হয়ে যাবে যেকোনো ক্রিকেটপ্রেমীরই। কিন্তু, এটাও তো নতুন নয়। শেষ কয়েক বছরে তো সাকিবকে ছাড়াই অসংখ্য ম্যাচ খেলতে হয়েছে টাইগারদের, বলা ভালো ‘খেলেছে টাইগাররা’। কিছু সিরিজে ছিলেন না ইনজুরির কারণে, কোথাও কোথাও নিয়েছিলেন ছুটি। সাকিবের এই যাত্রাটার সাথে নিশ্চয়ই এতদিনে মানিয়ে নিতে শুরু করেছেন সকলেই, সবকিছুর সাথে পেরেছেন কি?

সাকিবের বিতর্কিত অধ্যায়ের কিছু অংশ

সেরা পারফর্মার, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, সবচেয়ে বড় তারকা, পোস্টার বয়! সাকিবকে এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে বোধহয় এই শব্দগুলোই আসবে ঘুরে ফিরে। এসবের সাথে কেউ কেউ হয়তো আরও একটা শব্দ যোগ করতে চাইবেন, “বিতর্কিত” তারকা। গত সাত বছরে চারবার নিষিদ্ধ হয়েছেন; বিভিন্ন সময়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন নেতিবাচক কারণে। ঘটনাগুলোর সূত্রপাত কোথায় সেটা খুঁজতে একটু পেছনে যাওয়া যাক।

ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ, ২০১০; প্রথমবার বিতর্কে সাকিব আল হাসান। ব্যাট করার সময়ে সাইড স্ক্রিনের পাশে এক দর্শকের নড়াচড়ায় অসুবিধে হচ্ছিলো ব্যাটিংয়ে। পিচে দাড়িয়ে সরে দাড়ানোর ইঙ্গিতও দিচ্ছিলেন, কাজ না হওয়ায় ক্রিজ ছেড়ে দৌড়ে গেলেন ব্যাট উঁচিয়ে মারতে।

২০১১ সালের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ রানে অলআউট হয়ে দর্শকদের দুয়োধ্বনির জবাব মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে দেয়া, ২০১৩ সালে অটোগ্রাফ না পাওয়া ভক্তের কটুক্তিতে কলার চেপে ধরা সবই যেন সময়ের সাথে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে দিয়েছে ‘অ্যারোগেন্ট’ তকমা। কিন্তু, তাতে সাকিবের বিপরীতে কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহসও দেখাতে পারেনি বোর্ড।

অবশেষে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো নিষিদ্ধ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। অশোভন অঙ্গভঙ্গির কারণে সাকিব মাঠের বাইরে তিন ম্যাচ, গুনতে হয়েছিল জরিমানা। একই বছর ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ চলাকালে স্ত্রী শিশিরকে উত্ত্যক্ত করায় এক দর্শককে পেটান সাকিব। কোচের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে নিষিদ্ধ হোন ছয় মাস। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের ২০১৪ সালটা ছিল ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কালো অধ্যায়।

২০১৫ তে বিপিএলে আম্পায়ারের সাথে তর্ক, ২০১৮ সালের নিদহাস ট্রফির প্রতিবাদ, ২০১৯-এ বাজিকরদের প্রস্তাব আইসিসিকে না জানোনোর জন্য দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা! সব তো ঐ ‘বিতর্কিত’ সাকিবকেই তুলে ধরে।

লম্বা সময় মাঠের বাইরে থাকার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ দিয়ে সাকিবের প্রত্যাবর্তন। ভক্ত-সমর্থকদের আশা এবার পিছু ছাড়বে বিতর্ক। কিন্তু, সাকিব মানেই তো ততোদিনে আলোচনা-সমালোচনা; যুক্তরাষ্ট্রে বসে লাইভ কিংবা শ্রীলঙ্কা সিরিজকে উপেক্ষিত করে আইপিএল খেলার সিদ্ধান্ত, সবমিলে আরও একবার বিতর্কে সাকিব। সর্বশেষ ঘটনা ডিপিএলের সেই স্ট্যাম্পে লাথি…

কিন্তু, সাকিব চিরকাল খেলে গেছে দাপটের সাথেই। সেদিনও ছিলেন দলের সেরা পারফর্মার, আজও তাই..

অনুমান করাই যায়, সময়ের সাথে সাথে এই আঘাতগুলো সাকিবকে ভাবিয়েছে, ভাবতে বাধ্য করেছে। একটা মানুষ যে দেশের জন্য নিজের সবটা উজাড় করে দিয়ে খেলেছে, বিভিন্ন সময়ে সেই মানুষটাই যখন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন তখন মনে নানান রকমের ভাবনা আসাটাই স্বাভাবিক। পাথর হয়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু, সাকিব বলেই হয়তো তাকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে অন্য ভাবে, সাকিব যে সুপারম্যান! সাকিব বলেই হয়তো তবুও হেসে গেছেন প্রাণখুলে, সাকিব বলেই হয়তো এত ভাবনার মধ্যেও খেলে যেতে পারেন দাপটের সাথে। শেষ করার আগে উৎপল শুভ্রকে দেয়া সাকিবের সাক্ষাৎকার থেকে কিছু লাইন লিখতে চাই।

“আমি চাই শান্তিতে থাকতে, ফোকাসে না আসতে, দূরে থাকতে। আমি জানি, আমাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ সবসময় থাকবে না। আর সুবিধা হয়েছে কি, সাসপেন্ড হয়েছি দুইবার। যা আমাকে আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, কী হতে পারে।” (নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে)

“এমন না যে, ক্রিকেটটা এনজয় করি না। এনজয় করি, পারফর্মও করতে চাই…আবার কমিটমেন্টের পয়েন্টটাও ঠিক আছে। ক্রিকেটই টপ প্রায়োরিটি কি না, বলতে পারব না! তবে যখন খেলার ভেতরে ঢুকি, যদি চ্যালেঞ্জ আসে, সেটা ওভারকাম করার একটা তাড়না কিন্তু থাকেই।” (ক্রিকেট নিয়ে)

“মানুষ তো শুধু ভাবে আমি খেলতে চাই কি চাই না, কিংবা এরকম না হলে ওরকম হতো! কিন্তু আপনি এটা চিন্তা করেন তো আমি কত স্যাক্রিফাইস করছি। এটা মানুষ দেখে না। কাউকে বলেন তো আমার মতো ফ্যামিলি ছাড়া এমন একা একা থাকতে-খেলতে; দেখি কয়জন সারভাইব করতে পারে। আপনি আমাকে আর একটা প্লেয়ার দেখান তো এমন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ফ্যামিলি ছাড়া খেলছে। বাংলাদেশ তো বাদই দিলাম, আপনি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটেই আর একটা এমন প্লেয়ার দেখান না!” (দেশের জন্য কতটা নিবেদিত প্রাণ সেটা বোঝাতে)

দেশের জন্য সাকিব কতটা নিবেদিত প্রাণ তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠলেও সাকিব যে কখনোই এসবের তোয়াক্কা করেননি সেটাও বহুবার বলেছেন। খেলে গেছেন, সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছেন, দেশের নামটা করেছেন আলোকিত। সাকিবের হাজারও অর্জন, তাকে নিয়ে সাজানো শত শত রুপকথার সবই সত্য। সেইসাথে সত্য হয়তো এটাও যে, সাকিব আজকাল বেশ বদলে গেছেন।

আসলে আজকাল নয়, সাকিবকে বদলে দিয়েছে ২০১৪ সাল; আর তা অকপটে স্বীকার করেছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। এখন আর আগের প্যাশন নিয়ে খেলেন না, তবে মাঠে নামলেই দিতে চান নিজের সেরাটা। অথচ এই সাকিবই বিশ্বমঞ্চে চিনিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে, নতুন করে নতুন রুপে। সাকিবের কারণেই র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে দেখা হয়েছে বাংলাদেশের পতাকা। দেশের জন্য খেলতে গিয়ে ঝুকিও তো কম নেননি, হারাতে বসেছিলেন আঙ্গুলটাই! সেই সাকিব বাংলাদেশ ক্রিকেট নামক চেনা গল্পটাতেই আজকাল বড্ড অচেনা!

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -

সর্বশেষ

- Advertisement -
- Advertisement -spot_img