২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, শুক্রবার

নিহত নক্ষত্রের গল্প

- Advertisement -

হুট হাট করেই শূন্য ঘরের মধ্যে এক টুকরো সাদা কাগজ খুঁজতে শুরু করলেন আলবার্ট ট্রট। দেনা-দায় পেরিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় এখন, তবে সাধারণ বিদায় নয়, বলা যায় মর্মান্তিক এক পরাজয়। কাগজ পেলেন না, তাই বাধ্য হয়েই লন্ড্রি বিলের উল্টো পিঠে বাড়ির মালিক ভদ্রমহিলাকে ওয়ার্ডরোব আর চার পাউন্ডের উইল লিখে দিয়ে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগার চেপে দিলেন, ৪১ বছর বয়সেই পৃথিবী ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমালেন ট্রট, আলবার্ট ট্রট।

ট্রট আসলেই মৃত্যুর আগে সাদা কাগজ খুঁজেছিলেন কিনা জানা নেই তবে ট্রটের আত্মহত্যার গল্পটা সত্য। যেমন সত্য; প্রথম এবং ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে বল ছক্কা মেরে লর্ডসের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব। যা আজ অব্দি কেউ করে দেখাতে পারেনি। অথচ ট্রট আরও একবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। যদিও মন্টি নোবেলের ওভারে ট্রটের মারা সেই বলটা লর্ডসের প্যাভিলিয়নের ছাদের চিমনিতে লেগে পড়েছিল পাশের র‌্যাকেট কোর্টে, আর সেই জায়গাটাকে তখন মাঠের অংশ বলেই বিবেচনা করা হতো। বলে রাখা ভালো, সেই সময় বল মাঠের বাইরে গেলেই কেবল সেটাকে ছক্কা হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তাই দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ট্রটকে চার রানেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।

আলবার্ট ট্রটের অভিষেক হয়েছিল রূপকথার মতো। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৮ নম্বরে নেমে ব্যাট হাতে অপরাজিত ৩৮ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেন অপরাজিত ৭২ রানের ইনিংস। প্রথম ইনিংসে বল করার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ৩ ওভার, দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে পর্যাপ্ত সুযোগ পেয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছেন এমসিসির (তৎকালীন ইংল্যান্ড) ব্যাটিং লাইন-আপ। ৪৩ রান খরচায় নিয়েছেন ৮ উইকেট। ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা অস্ট্রেলিয়া তার অলরাউন্ড নৈপুণ্যেই ফিরেছিল সিরিজে। ওই ম্যাচেই আলবার্টের বিপক্ষে খেলেছিলেন তার ভাই, হেনরি ট্রট।

প্রথম তিন টেস্টে ট্রটের গড় ছিল ১০২.৩। অথচ পরের বছর ইংল্যান্ড সফরের দলে জায়গা হয়নি তার। সেই সফরে আবার অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়ক ছিলেন তার ভাই হেনরি ট্রট। দলে জায়গা না হলেও অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে একই জাহাজে ইংল্যান্ড যান আলবার্ট। লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডে পাকাপোক্ত ভাবে থেকে যাওয়া৷ সেই উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেছিলেন গ্রাউন্ডস স্টাফদের সঙ্গে। ওই সফরেই আলবার্টের ভাই হেনরি ট্রট খেলেন লর্ডসে তার সেরা ১৪৩ রানের ইনিংস।

১৮৯৮ সালে শুরু হয় আলবার্ট ট্রটের কাউন্টি ক্যারিয়ার। ১৮৯৯ সালে ট্রট এক বছরে করেন ১১৭৫ রান, সাথে ২৩৯ উইকেট। পরের বছর এই অল-রাউন্ডার ছিলেন আরও দুর্দান্ত। ব্যাট হাতে ১৩৩৭ রানের পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ২৭১ উইকেট। আলবার্ট ট্রট ইংল্যান্ডের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ব্যাট হাতে ব্যর্থ হলেও বল হাতে ১১.৬৪ গড়ে ট্রটের শিকার ছিল ১৭ উইকেট।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষটাও ওখানেই। তবে “আলবার্ট ট্রট শো” বাকি ছিল তখনও। ১৯০৭ সালে কাউন্টি দল সমারসেট-এর বিপক্ষে ৪ বলে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন ট্রট। এককথায় অবিশ্বাস্য ছিল ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে তার সেই বোলিং স্পেল। এর বছর তিনেক পর অবসরে যান কাউন্টি থেকে। মাঠের ক্রিকেট ছাড়লেও খেলাটার সাথেই ছিলেন তিনি। ক্রিকেটার থেকে বনে যান আম্পায়ার। ততদিনে মদ আর জুয়ায় আচ্ছন্ন আলবার্ট ট্রটের ব্যক্তি সত্ত্বা অনেকটাই বিলীন হয়েছে, দেনার দায়ে ডুবেছেন, হয়েছেন কপর্দকহীন। হয়তোবা নিজের কাছেই ছিলেন মূল্যহীন, নইলে আত্মহত্যার পথ কেন বেছে নেবেন!! যার ক্রিকেট ক্যারিয়ার হতে পারতো সোনা রাঙ্গা, সেই মানুষটাই যখন নেশার অন্ধকারে নিজেকে সঁপে দেন, তখন আলোর সোনালি রেখার হাত ধরে নতুন সূর্যের সম্ভাবনার প্রভাত উঁকি দেয় না, ঘোর অমানিশা ধেয়ে আসে; ট্রটের জীবনেও ব্যতিক্রম হয়নি।

আলবার্ট ট্রট যখন নিজের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগার চাপছিলেন, তখন কি তার হাত কাঁপছিল? কে জানে! হয়তো, আবার হয়তো না। প্রায় ১০৬ বছর আগে নিজ ঘরে আত্মহত্যা করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের বিস্ময়। আপনি তাকে ইংলিশদের অংশও বলতে পারেন। জনাব ট্রট বেঁচে থাকলে হয়তো আপত্তি করতেন না।

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -

সর্বশেষ

- Advertisement -
- Advertisement -spot_img