তখন মধ্যরাত, প্রায় হাজার মাইল দূরের দেশ ওয়েলসের কার্ডিফ থেকে বাংলাদেশ বরাবর একটা চিঠি আসলো। বাড়িতে তখন ডাকবাক্স নেই, পাশের বাড়ী থেকে অপ্রত্যাশিত চিঠির খবর পেলাম। ঘুম ভেঙ্গে দৌড়ে গেলাম, মাঝপথে হোঁচট খেলাম এবং তারপর কম্পনরত শরীর সেই চিঠির স্পর্শ পেল। মসৃণ খামটা খুলে পড়তে শুরু করলাম , একসময় পড়া শেষ হলো কিন্তু কল্পনার ঘোর যেন কাটছিলই না।
প্রিয় বাংলাদেশ,
কখনো কি ভেবেছিলে, একটি শতক গোটা একটি দেশের ঘুম ভাঙ্গাতে পারে? কখনো কি ভেবেছিলে, যারা অশিক্ষিত, বর্বর আখ্যা দিয়ে প্রায় দুইশত বছর তোমাদের শাসন করেছে তাদের বংশধরেরা আমার বুকে দাঁড়িয়ে তোমার নাম মুখে উল্লাস করতে পারে? শুধুমাত্র একটি জয় সব ইতিহাস,কল্পনা,চিন্তা বদলে দিতে পারে?
আমি ভাবিনি, কিন্তু তাতে কি আসে যায়! হয়েছে-যে সেটাই। সত্যি বলতে এমন প্রানবন্ত উল্লাস আমি এর আগে কখনো দেখিনি। গ্লেন ম্যাকগ্রা–রিকি পন্টিংদের অস্ট্রেলিয়াকে তোমার ছেলেরা এভাবে গুড়িয়ে দেবে সেটা কেউ ভাবেনি। প্রথম ইনিংসের প্রথম ওভারে মাশরাফীর দ্বিতীয় বলটা যখন এডাম গিলক্রিস্টের প্যাডে আঘাত হানলো, হঠাত করেই শরীরটা তখন কেমন যেন কাঁপন দিয়ে উঠলো। আম্পায়ার আঙ্গুল তুললেন, গিলি প্যাভিলিয়নের পথ ধরলেন। ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে ফিরে গেলেন পন্টিং, তবে ছোট বড় জুটিতে তাসমান পাড়ের দেশটা ঠিকই সামলে উঠলো শুরুর ধাক্কা, নির্ধারিত পঞ্চাশ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে জমা হলো ২৪৯ রান।
পন্টিং হয়তো ভেবেছিলেন যথেষ্ট, ম্যাকগ্রা হয়তো গিলিকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, আরে ভাবিস না, বাংলাদেশ ভালো খেললে বড়জোর দুইশর গণ্ডি পেরুতে পারবে।
তোমাদের শুরুটাও হয় নড়বড়ে। দলীয় ১৭ রানে ফিরে গেলেন নাফিস ইকবাল, তুষার ইমরানের ব্যাট কড়া ভাষায় কথা বলার আভাস দিলেও সায়মন ক্যাটিচের দুর্দান্ত ক্যাচে সেই স্বপ্ন কোনো পার্থক্য গড়তে পারলো না। কিছুক্ষণ পর ফিরে গেলেন জাভেদ ওমরও। তোমার প্রতিটা উইকেট যেন গ্যালারির দীর্ঘশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।
তবে এরপর গল্প নিলো ভিন্ন মোড়। মোহাম্মদ আশরাফুল নামের একটা ছেলে গোটা দৃশ্যপট পাল্টে দিল। তার সঙ্গে ছিলেন তোমাদের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। তাদের জুটি ভাঙ্গল রান আউটের ফাঁদে পড়ে, বাশার ফিরলেন, কিন্তু ততক্ষণে ঠিকই তৈরি করে দিয়ে গেলেন জয়ের ভীত।
মোহাম্মদ আশরাফুল তুলে নিলেন শতক, উইকেট-কিপিং পয়েন্টে যেতে যেতে গিলির হাত তালির দৃশ্যটা সেই সময় অব্ধি আমার ’লাইফ অব দ্যা মোমেন্ট’। শতকের পরপরই ফিরে গেলেন আশরাফুল। ম্যাচের শেষ ওভারে বাংলাদেশের দরকার ছিল ৭ রান, স্ট্রাইকে ছিলেন আফতাব আহমেদ। ১৯ বছর বয়সী ছেলেটা শেষ ওভারে প্রথম বলটাই মিড অনের উপর দিয়ে পাঠালেন সীমানার বাইরে। অজি অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের চেহারাটা তখন ঠিক কি কারণে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল আমি জানি না। হয়তো প্রবল বিস্ময়ে কিংবা মুখ লুকোতে না পারার লজ্জায়।
ইনিংস দ্বিতীয় বলেও ছক্কা হাঁকাতে চেয়েছিলেন আফতাব, তবে পারলেন না। কিন্তু কি আসে যায়, জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রানটা ঠিকই এসে গেল। ড্রেসিংরুমের বারান্দা থেকে উল্লাসের মিছিল নেমে এলো আমার বুকে। আহা কি মূহূর্ত, ‘দ্যা মাইটি অস্ট্রেলিয়া’কে মাটিতে নামিয়ে আনার আনন্দ।
চিঠি পড়তে পড়তে হয়তো ভাবছ আমি কে? আমি সোফিয়া গার্ডেন, আজ সেই ১৮ জুন, তোমরা ভুলে গেলেও যুগের পর যুগ তোমাদের ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলবে আমার নাম, আমার বুকে ইতিহাস হয়ে থাকা তোমাদের প্রথম অস্ট্রেলিয়া বধের গল্প।