শেফালি ভার্মার নাম বাংলাদেশের কজন মানুষ শুনেছেন তা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। তবে ক্রিকেটবিশ্বের খোঁজ যারা রাখেন তাদের কাছে ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের রোহতাক শহরের এই নারী ক্রিকেটার এক বিষ্ময়ই বটে। অভিষেকের ২১ মাসেই দুবার হয়েছেন আন্তর্জাতিক নারী টি২০র এক নম্বর ব্যাটার। শেফালির অভিষেকের পর নারী টি২০ তে তারচেয়ে বেশি ছক্কা হাকায়নি অন্য কেউ। ভারত কে নিয়ে গেছেন নারী টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে। আর কাল অভিষেক টেস্টে ব্যাট করতে নেমেই খেললেন অভিষেকে ভারতের কোনো মহিলা ব্যাটারের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। ৯৬ রানে আউট হওয়ার আগে টপকেছেন আগের সর্বোচ্চ চন্দ্রকান্ত কৌরের ৭৫ রানের ইনিংসকে। আর এসবই শেফালি করেছেন ভোট দেয়ার অধিকার পাওয়ার আগে; শেফালির বর্তমান বয়স যে মাত্র ১৭ বছর ১৪১ দিন!
Smile & the world smiles with you ? pic.twitter.com/odptLGeZmh
— Shafali Verma (@TheShafaliVerma) February 16, 2021
শেফালির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুই হয় রেকর্ড দিয়ে। ২০১৯ এর সেপ্টেম্বরে প্রথম যখন জাতীয় দলে ডাক পেলেন তখন তার বয়স ১৫ হয়েছে কেবল। ভারতের ক্যাপ মাথায় দেয়ার সাথে সাথেই নারী পুরুষ মিলিয়ে ক্রিকেটে ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হয়ে যান শেফালি ভার্মা। অভিষেকের পর থেকেই নিজের স্বভাবসুলভ হার্ড হিটিং দিয়ে নিজেকে করেছেন ভারতের নারী টি২০ দলের অপরিহার্য অংশ। অনেক নামিদামি ক্রিকেটার যখন স্ট্রাইক রেট নিয়ে স্ট্রাগল করে তখন শেফালির স্ট্রাইক রেট ১৪৮.৩১! ২২ ম্যাচে তিনি হাকিয়েছেন ২৯ টি ছয়! আর এসব রেকর্ডই তাকে ২০২১ এ ইংল্যান্ডে হতে যাওয়া ১০০ বলের নতুন টুর্নামেন্ট “দ্যা হান্ড্রেড” এবং অস্ট্রেলিয়ার “নারী বিগব্যাশ” লিগে দল পাইয়ে দেয়।
শেফালি ভারতীয় টি২০ দলের প্রাণভোমরা হওয়ার পর ডাক পেয়েছেন ওডিয়াই এবং টেস্ট দলেও। আর টেস্ট অভিষেকেই ১৭জুন বৃস্টলে ১৫২ বলে ৯৬ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলেন। যে ছক্কা মারার জন্য এতো নামডাক শেফালির; অভিষেকেও তা বজায় রেখেছেন তিনি। প্রথম ভারতীয় নারী ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেকে মেরেছেন ছক্কা। ৯৬ রানে কেট ক্রসের বলে আউট না হলে হয়তো পেয়ে যেতেন কাংখিত শতক টাও। তবে, যতক্ষন পিচে ছিলেন ততোক্ষন ইংল্যান্ড কে স্বস্তিতে থাকতে দেননি। আরেক ওপেনার স্মৃতি মান্দানার সাথে করেছেন ১৬৭ রানের জুটি। ভার্মা আউট হওয়ার পরই অবশ্য ধ্বস নামে ভারতের ইনিংসে। ১৬৭-০ থেকে ভারত ১৮৭-৫ এ দিন শেষ করে।
Big wicket for England!@TheShafaliVerma falls just FOUR short of what would have been a sensational maiden Test hundred.
Batted, Shafali ?#ENGvIND | https://t.co/Vzg0fwYsnc pic.twitter.com/nd8exRZykW
— ICC (@ICC) June 17, 2021
শেফালির উঠে আসার গল্প টাও বেশ সিনেম্যাটিক। বাবা ক্রিকেটার ছিলেন এবং শেফালির ভাইকে অনুশীলন করাতেন তিনিই। শেফালির দায়িত্ব ছিল বাপ-বেটার অনুশীলনে বল কুড়োনো। একবার দিনশেষে কয়েকটি বল খেলার সুযোগ পান শেফালি; তাতেই বাজিমাত করেন তিনি। তার খেলা শটে বাবাকে বুঝাতে সক্ষম হন শেফালি নিজেও এখন ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য প্রস্তুত। আরেকবার তো ছেলেদের ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ভাইয়ের জার্সি পরে খেলে হয়েছিলেন ম্যান অব দ্যা সিরিজ। ভাই অসুস্থ থাকায় ভাইয়ের যায়গায় ব্যাট করতে নেমে এই কীর্তি গড়েন তিনি। এরপর, নারী ক্রিকেট একাডেমি তে যায়গা হয় শেফালি ভার্মার। এক অনূর্দ্ধ ১৬ নারী ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সব ম্যাচেই হাফসেঞ্চুরি হাঁকান এই ডানহাতি ব্যাটার। এরপরেও হরিয়ানা ক্রিকেট এসোসিয়েশন অনূর্দ্ধ ১৯ নারী দলে রাখেনি ভার্মা কে। তখনই জেদ ধরেন ভার্মা, বয়সভিত্তিক নয়, সরাসরি খেলবেন ভারতীয় জাতীয় দলে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সেই স্বপ্ন পূরনও হয়ে যায় শেফালির।
জেদ, চেষ্টা আর ত্যাগই শেফালিকে আজ নারী টি২০ ব্যাটার র্যাংকিংয়ের ১ নম্বর ব্যাটার বানিয়েছে। তার বয়সীরা যখন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে গেছে অথবা পুতুল নিয়ে খেলেছে শেফালি মাথার চুল কেটে কাঁধে নিয়েছে ক্রিকেটের কিটব্যাগ। সেই জেদ আর চেষ্টা আজও রয়েছে তার ভেতর। শর্ট বলে দুর্বলতা কাটাতে হরিয়ানা ক্রিকেট এসোসিয়েশনের পুরুষ ক্রিকেটারদের সাথে প্র্যাক্টিস করেছেন। খেলেছেন, হার্শাল প্যাটেল, মোহিত শর্মা, রাহুলা তেওয়াতিয়াদের বল। ক্রিকইনফো কে দেয়া সাক্ষাতকারে শেফালি ভার্মা বলেন, “আমার টার্গেট থাকে প্রত্যেক সিরিজ থেকে শিখে ক্রিকেটার হিসেবে আরও উন্নতি করার।“ তিনি আরও বলেন “ কোন কিছু অর্জনের চেষ্টায় অসফল হয়ে একবারেই হাল ছেড়ে দিলে কখনোই সফলতা আসবেনা। আমি একবারেই টানা ১৫০ টা বাউন্সার খেলতাম, কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে আবার বাউন্সার খেলা শুরু করতাম। আমি প্রত্যেকদিন এই একই জিনিস করার দিকে মন দিয়েছিলাম” এই একাগ্রতা শেফালি কে সফলতা এনে দিয়েছে সাথে সাথেই। ২০২০ এর নারী টি২০ বিশ্বকাপের পর সাউথ আফ্রিকার সাথে সিরিজে ভারত হারলেও শেফালি ৩ ম্যাচে যথাক্রমে করেছেন ২৩,৪৭ ও ৬০ রান। আর ফলস্বরুপ; শেফালি এখন নারী টেস্ট ক্রিকেট এলিট ফ্যামিলির কনিষ্ঠতমদের একজন।
শেফালি ভার্মারা আসেন অবারিত প্রতিভা নিয়ে, কেউ টিকে যান আর কেউ যান হারিয়ে। শেফালি ভার্মার পরিশ্রম বলে তিনি টিকে যাবেন। ধুমকেতু নয়, বরং ধ্রুব তারা হয়ে জ্বলবেন ক্রিকেট আকাশে। যে ধ্রুব তারা কে দেখে ক্রিকেটে আসবে অন্য মেয়েরা; যে ধ্রুব তারাকে দেখে পরিশ্রম করতে শিখবে ছেলে মেয়ে সকল ক্রিকেটারই। সামনে অপেক্ষমান বিরাট ক্যারিয়ারে সফলতার জন্য শেফালি ভার্মাকে অলরাউন্ডার পরিবার জানায় অগ্রিম শুভকামনা।