দর্শকদের চিৎকার, সঙ্গে ভুভুজোলার মন মাতানো সুর। ফুটবল যদি হয় কোনো উপন্যাস, সেই উপন্যাসের ভূমিকাজুড়ে নিশ্চই থাকবেন দর্শকরা। ফুটবলের রোমাঞ্চ বাড়িয়ে দেওয়া দর্শকদের কাছে অবাক হওয়ার মতো তথ্য, চলতি ইউরোর সেমিফাইনালে ওঠা চার দলই কোয়ার্টারে খেলেছে সাদা জার্সি পড়ে। ইউরোর ইতিহাসে এর আগে এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা সেটা জানতে ভাবনার ডাকঘরে আপনাকে চিঠি পাঠাতে হতে পারে, তবে সেই চিঠির উত্তর আদৌ আসবে কিনা সেটা নিয়েই যত সন্দেহ।
EURO 2020 semi-finals set ✅
????? Italy vs Spain
?????????? England vs DenmarkWho are you backing to lift the ?❓#EURO2020 pic.twitter.com/SjjvZ6PSAb
— UEFA EURO 2020 (@EURO2020) July 3, 2021
চলতি ইউরোকে এক লাইনে বর্ণনা করতে বলা হলে কিভাবে করবেন? নিশ্চয়ই ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের সেরা-সেরা ফুটবলারদের এক আসরে দেখা, গতিময় ফুটবলে বুঁদ হওয়া কিংবা ধারে-ভারে দুর্বল হয়েও অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দলগুলোকে হারিয়ে দেওয়া। এর বাইরেও গল্প আছে, তবে যতটা না আনন্দের-শৌর্যবীর্যের, তার থেকেও বেশি লজ্জ্বার। শুনলে অবাক হবেন, চলতি ইউরোতেই সবচেয়ে বেশি আত্মঘাতী গোল হয়েছে। ইউরোর সবশেষ পনেরো আসরে আত্মঘাতী গোল হয়েছিল নয়টা, আর এবারেই নিজেদের জালে খেলোয়াড়রা বল জড়িয়েছেন দশ-দশবার। ডিফেন্ডারদের জন্য এর থেকে লজ্জ্বার আসর বোধহয় আর হতে পারে না।
There have now been more own goals at Euro 2020 than at every other Euros combined ?♂️ pic.twitter.com/oDNi4Qfcwc
— ESPN FC (@ESPNFC) July 2, 2021
সকালের সুর্য দেখেই অনেকসময় বলে দেওয়া যায় দিন কেমন যাবে। যে আসর শুরুই হয়েছে আত্মঘাতী গোল থেকে, মোটা দাগে তো বলে দেওয়াই যায় সেই আসরে থাকবে আত্মঘাতী গোলের আধিক্য। উদ্বোধনী ম্যাচে ইতালির বিপক্ষে নিজেদের জালেই বল জড়িয়েছেন তুরস্ক ডিফেন্ডার মেলি দেমিরাল। ফলে ইউরো ইতিহাসে প্রথমবার টুর্নামেন্টের প্রথম গোল এসেছিল আত্মঘাতী থেকে। ইউরো ইতিহাসের সবথেকে দ্রুততম আত্মঘাতী গোলও এসেছে এবারের আসরে। পোল্যান্ড-স্লোভাকিয়ার ম্যাচে মাত্র ১৮ মিনিটে আত্মঘাতী গোল করে বসেন পোলিশ গোলরক্ষক ওজিয়েক সেজনি। জুভেন্টাস গোলরক্ষক আরো একটি লজ্জ্বার রেকর্ডের অংশ হয়েছেন। ইউরো ইতিহাসের প্রথম গোলকিপার হিসেবে আত্মঘাতী গোলও দিয়েছেন সেজনি।
জার্মানি-পর্তুগালের বিগ ম্যাচ। সে ম্যাচের আগে ইউরোতে কখনোই এক ম্যাচে জোড়া আত্মঘাতী গোল দেখেনি বিশ্ব। সেই অপুর্নতাও ঘুচেছে! জার্মানির বিপক্ষে মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে পর্তুগালের রুবিন দিয়াস এবং রাফায়েল গুরায়রা নিজেদের জালেই জড়িয়েছেন বল। এবারের আসরেই একই ম্যাচে দুটো আত্মঘাতী গোল হয়েছে আরেকবার, গ্রুপ-পর্বের শেষদিনে এই লজ্জ্বার অংশ স্লোভাকিয়ার গোলরক্ষক মার্টিন দুভ্রাবকা এবং মিডফিল্ডার জুরাজ কুচকা ।
সকালের সূর্যের কথা বলছিলাম, পেনাল্টি মিসের হারটাও পাল্লা দিয়েছে আত্মঘাতী গোলের সঙ্গে।ইউরোর চলতি আসরের তৃতীয় ম্যাচেই প্রথম পেনাল্টির দেখা মেলে, সেই পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ডেনিশ ফুটবলার এমিল হুবিয়ার। এবার ইউরোতে পেনাল্টি পেয়েছে ১৬টি, বিগত আসরগুলোর মধ্যে যা সবচেয়ে বেশি। এর আগের সেরা ২০০০ ইউরোতে, সেবার ফুটবলাররা পেনাল্টি পেয়েছিল ১৩টি । ১৬ পেনাল্টির মধ্যে সাতটা পেনাল্টিই আবার মিস হয়েছে, মিসের রেকর্ডেও যা ছাড়িয়ে গেছে বিগত আসরগুলোকে। ইউরোতে সর্বমোট পেনাল্টি হয়েছে ৮৭টি; যার মধ্যে ৬১টি গোল হয়েছে, মিস হয়েছে ২৬টি।
পেনাল্টি থেকে গোল করায় ইউরোতে সবার সেরা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। পেনাল্টি থেকে পর্তুগিজ সুপারস্টারের সর্বমোট গোল চারটি, যার তিনটাই আবার এসেছে চলতি আসরে। নির্দিষ্ট এক আসরে পেনাল্টি থেকে তার চেয়ে বেশি গোল নেই আর কারো। পেনাল্টি গোলের মতোই সর্বকালের সর্বোচ্চ ইউরো গোলদাতাও আবার সি আর স্যাভেন। ১৪ গোল করে ইউরোপের সেরা গোলদাতা এখন তিনি, পিছনে ফেলেছেন ৯ গোল করা মিশেল প্লাতিনিকে। যার পাঁচটি আবার করেছেন হেড দিয়ে, এখানেও ইউরোতে সবার সেরা। এই আসরে পাঁচ গোল করে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনি। ইউরোতে রোনালদো কমপক্ষে তিন গোল করেছেন তিন আসরে, যার আর পারেনি কেউই।
Sterling & Dolberg in contention ?
Who will claim the ?❓@Alipay | #EUROTopScorer | #EURO2020— UEFA EURO 2020 (@EURO2020) July 4, 2021
গ্রুপ পর্বে ফ্রান্স-পর্তুগালের হাইভোল্টেজ ম্যাচে তিনটা পেনাল্টি দেখেছে ফুটবল, ইউরোর এক ম্যাচে এরচেয়ে বেশি পেনাল্টি আর কখনোই হয়নি। সেই ম্যাচে দুটো পেনাল্টি থেকে গোল করেছিলেন রোনালদো, ফলে এক ম্যাচে পেনাল্টি থেকে গোল করায় সবার উপরে রোনালদো। এক ম্যাচে দুটো পেনাল্টি নিয়েছিলেন আরেকজন, স্পেনের দানি। ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে একটা পেনাল্টিকে গোলে পরিনত করার পাশাপাশি আরেকটা করেছিলেন মিস।
পেনাল্টির বিপক্ষে সবচেয়ে বেশিবার পড়েছে আবার ফ্রান্স, ইউরোতে ১৩বার ফরাসি গোলকিপারদের পেনাল্টি ঠেকাতে হয়েছে। ফরাসি গোলকিপার হুগো লরিস আবার সবচেইয়ে বেশিবার পেনাল্টির সামনে পড়েছেন, ছয়বার পেনাল্টিতে তিনি ঠেকিয়েছেন মাত্র একটা। গোলকিপারদের সবচেয়ে মর্যাদার রেকর্ডের মালিক ইংলিশ গোলরক্ষক জর্দান পিকফোর্ড। ইউরোর প্রথম দল হিসেবে প্রথম পাঁচ ম্যাচেই ক্লিনশিট বজায় রেখেছে ইংল্যান্ড, যেখানে গোলবারের নিচে ছিলেন এভারটন গোলকিপার।
England are the first team in Euro history to start their campaign with five clean sheets in a row! ?
England 1-0 Croatia
England 0-0 Scotland
England 1-0 Czech Republic
England 2-0 Germany
England 4-0 Ukraine pic.twitter.com/z9D8IHOqjx— ESPN FC (@ESPNFC) July 3, 2021
তুরস্কের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের ম্যাচে একাই তিনটা গোল করিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের উইংব্যাক স্টিভেন জুবের। ইউরোতে এক ম্যাচে তার চেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট আর কারো নেই। এক ম্যাচে তিন অ্যাসিস্ট নিয়ে তার সঙ্গী হিসেবে আছেন তুরস্কের হামিত আলতিন্তপ। ২০০৮ সালে চেক রিপাবলিকের বিপক্ষে মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যবধানে তিন অ্যাসিস্ট করান তিনি। জুবের চলতি আসরে গোল বানিয়েছেন চারটা, একটা নির্দিষ্ট টুর্নামেন্টে জুবেরের থেকে বেশি অ্যাসিস্ট আর কারো নেই। চার অ্যাসিস্ট নিয়ে তার সঙ্গী লুবিঙ্কো দ্রুলোভিচ, ক্যারেল পভোরস্কি, ইডেন হ্যাজার্ড এবং অ্যারন রামসি।
The player with the most assists at EURO 2020? Steven Zuber.
He has four in four games for Switzerland ?#EURO2020 | #FRA #SUI pic.twitter.com/2loxzc3lWq
— Goal (@goal) June 28, 2021
চলতি ইউরোর দ্রুততম গোল সুইডেনের এমিল ফোর্সবার্গের। পোল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১ মিনিট ২২ সেকেন্ডের গোল আবার ইউরো ইতিহাসের দ্বিতীয় দ্রুততম গোল। পোল্যান্ডের ক্যাস্পার কজলভফস্কি আবার মাঠে নেমেই বনে গেছেন ইউরো ইতিহাসের সবচেয়ে কমবয়স্ক ফুটবলার। স্পেইন-ক্রোয়েশিয়ার রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ক্ল্যাশ আবার দেখেছে আট গোল, ইউরোতে এক ম্যাচে এরচে বেশি গোল আর হয়েছে একবার। ইউরোতে সর্বমোট গোল হয়েছে ৮২২, যার মধ্যে ১৩৫টাই হয়েছে এবারের আসরে। এক আসরে এত গোল আগে কখনোই হয়নি।
শুধুই মাঠের ধুন্ধুমার লড়াই নয়, রেকর্ডের জোয়ারেও ভাসছেন দর্শকরা। ইউরোর পর্দা নামার আগে বিগত দিনের সব রেকর্ড ভেঙ্গেচুড়ে যাবে, দর্শকদের হয়তো এটাই প্রত্যাশা।