বাংলাদেশ। নকশী কাঁথার মাঠ। খুলনা জেলার শেষ বিকেলের ঝড়ে খসে পড়া কাঁচা আমের যৌবন।চট্টগ্রামের অজ্ঞাত খালের ধারে বসে ভাই-বোনের শেষবারের জন্য আকাশ দেখা।তাদের নিজেদের দেশের আকাশ।শেষবারের জন্য।রাত পোহালেই বোর্খা পরে তাদের বেরিয়ে পড়তে হবে ভিটেমাটি ছেড়ে। হ্যাঁ, ভাইটাকেও পরতে হবে বোরখা। তারা বাঁচতেও পারে। তারা না বাঁচতেও পারে।শেয়ালদা স্টেশনে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা কাঁচা আমতেল রঙের সবজেটে ট্রেন।দে শভাগের পর তার কাজ ফুরিয়েছিল তখন। পঙ্গু হয়ে একাকী দাঁড়িয়ে শেয়ালদা স্টেশনে।
ইন্দুবালাও তো সেই কাঁচা আমতেল রঙের গা ছুঁয়ে পেয়ে যেত কবি জসীমউদ্দিনের পরশ।নকশী কাঁথার মাঠের পরশ।হারানো সাথী মণিরুলের পরশ। কপোতাক্ষের ধারের তুলসী মন্দিরটার শেষ প্রদীপ।একাত্তরে যশোর রোড বেয়ে এগিয়ে চলা খিদের লাইন।বাক্স-বাটরাতে লেগে থাকা চট্টগ্রামের দুপুরে বাঁশবাগানের হিমেল শীতল হাওয়া। মায়ের কাপড়ের সাথে বেঁধে নেওয়া ফুটফুটে শিশুর বুভুক্ষু নিষ্পাপ ড্যাবড্যাবে চোখ।মৌসুমি ভৌমিকের একাত্তরী অনুভব। “শত শত মুখ, হায় একাত্তর,যশোর রোড যে কত কথা বলে’’। বাংলাদেশ।
বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া মাস্টারদার নিথর দেহ।আগে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়। তারপর ফাঁসির নামে নামমাত্র দেহটাকে ঝুলিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সূর্য সেন লড়েছিলেন স্বাধীন ভারতের জন্য। পাকিস্তান চাননি।বাংলাদেশ চাননি।বাংলাদেশ। বাহান্নতে ভাষার লড়াই। একাত্তরে জীবনের লড়াই।খুলনার শেষ রাতের রক্তিম সূর্যের মৃদু আভায় কোনো এক ফাঁকা মাঠে একঝাঁক ভাষা শহিদের পিঠে ছোঁড়া কমিশনারের এনকাউন্টার।বাংলাদেশ।ঢাকার মসজিদের ভোরের আজান।আজানে মিশে যাওয়া রবীন্দ্রগীতি।
“ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি”
বাংলাদেশ। সালামের স্বপ্ন।রফিকের স্বপ্ন।বরকতের স্বপ্ন।জব্বারের স্বপ্ন।শফিউরের স্বপ্ন।সমস্ত ভাষা শহিদদের স্বপ্ন।খান সেনাদের জ্বালিয়ে দেওয়া বাড়ি।সাবজোটে শেয়ালদা যাতায়াত করা খুলনা জেলার ব্যাবসায়ীর শেষবারের জন্য কপোতাক্ষের ওপারের দেশটাকে দেখে নেওয়া।যশোর রোডের মিছিলে পা মেলায় ফরিদপুরের ফেলে আসা তুলসীর মন্দির, চাঁদপুরের গোবর জল দিয়ে নিকানো উঠোন,বকুলপ্রিয়াকে ইকবালের দেওয়া বিবাহের প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশ।
খুলনার চৌধুরী পরিবারের আমগাছটিতে বাঁধা দোলনাটা এখন একাই দুলতে থাকে। দোলনায় চাপতো যারা তারা নেই আজ।চলে গেছে সেই সত্তর বছর আগে।বাড়িটা আজ পোড়ো।খান সেনাদের জ্বালিয়ে দেওয়া।দুই দেশ।এক মাটি।এক গাছ।আলাদা আজ। দূরে আজ। বর্ডার।সীমানা।ভিসা। পাসপোর্ট। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যায়না সীমানা।দূরে আজ। অনেক দূরে।
তবু সাকিব পারলেন।কিছুটা পারলেন। মৈত্রী এক্সপ্রেস পারেনি।সেনা পারেনি।মন্ত্রী পারেনি।……সাকিব পারলেন…. কিছুটা পারলেন…
“আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পান
নীরবে বসিয়া কোন কথা যেন কহিতেছে কানে কানে”
দুই গাঁও এক কিছুটা সময়ের জন্য। দুই মাসের জন্য। সাকিব পারলেন।কিছুটা পারলেন। সাকিব পেরেছেন যখন আইপিএলে প্রতিটা উইকেট নিয়েছেন, রান করেছেন, তখন সাকিব পেরেছেন। বাংলার ক্রিকেটারদের যখন বারবার অবহেলা করা হয়েছে, ঋদ্ধিমান যখন ডাগ-আউটে বসে সতীর্থদের ব্যর্থতা দেখেছেন, তখন সাকিব পেরেছেন; পেরেছেন দুই বাংলার প্রতিনিধি হতে; দুই বাংলার সাকিব হতে। সাকিব পেরেছেন।
ভারত থেকে লিখেছেন জিশু নন্দী...