তরুণ খেলোয়াড়রা বলে সাকিব আল হাসান নাকি সুপারম্যান। ম্যাশ বলেন একটু ভিন্ন ভাবে; বাংলাদেশের সব ক্রিকেটারের যেই মেধা, সাকিবের একার মেধা নাকি তার চেয়ে বেশী। হাবিবুল বাশারের মতে সাকিব এক ভুল কখনোই দুইবার করেন না, মুশফিকুর রহিমের ভাবনা ‘শুধু বাংলাদেশেই নয় পুরো বিশ্বে সাকিব একজনই’। তামিম ইকবাল একবার বলেছিলেন সাকিব যেটা চায়, সেটাই নাকি করে ফেলতে পারে। তাহলে এবার কি করবেন সাকিব? কি করবেন ম্যাশের মিস্টার বাংলাদেশ!
কথাগুলোকে প্রথমে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতেই পারে, কিন্তু আইপিএলের নিলামও আসছে ঘনিয়ে। ইতোমধ্যেই বিসিসিআইকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নাকি জানিয়ে দিয়েছে সাউথ আফ্রিকার পর শ্রীলঙ্কা সিরিজেও দলে থাকবেন সাকিব। এমনটা হলে আইপিএলে শুরুতেও থাকা হবে না সাকিবের, থাকা হবে না শেষেও। মাঝখানে হাতেগোনা দুই একটা ম্যাচের জন্য যে সাকিবকে নিতে চাইবে না কোনো দলই সেটা অনুমান করাই যায়। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের ভিত্তিমূল্যই যে দুই কোটি!

টি-টোয়েন্টিতে ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করছেন সাকিব, বিপিএলে টানা চার ম্যাচেই হয়েছেন ম্যাচ সেরা। এমন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাকিবকে নিশ্চিতভাবেই পেতে চাইবে যেকোন দল। কিন্তু সাকিব বেছে নিবেন কাকে?
সাকিবের উত্তরটা সময়ই বলে দিবে। কিন্তু বিসিবির চাওয়াটা বলে দেওয়াই যায়। কদিন আগেই ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “আমরা এখন অব্দি জানি সাকিব সাউথ আফ্রিকা সিরিজে থাকছে। আইপিএলের প্লেয়ার্স ড্রাফট দেরি আছে, সাকিব হয়তো দলও পাবে। তারপর তাঁর সঙ্গে কথা বলে দেখব। তবে বিসিবি চায়, সে জাতীয় দলে সময় দিক।”
সাকিব দল পাওয়ার পরই যদি কথা বলতে হয়, তাহলে সেই কথা বলার প্রয়োজনীয়তাটাই বা কি সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। আইপিএলের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি হয়তো ইতোমধ্যেই যোগাযোগ করা শুরু করে দিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। সাকিব যদি মোটামুটি নিশ্চিত করে ফেলে আইপিএল খেলার ব্যাপারে, তাহলে সাকিব যে আরও একবার জাতীয় ভিলেনে পরিণত হতে যাচ্ছেন সেটা অনুমান করাই যায়।

সাকিব ক্রিকেটটা বুঝেন ভালো, এগোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার সাথে এইসব ব্যাপারে নেই বিন্দুমাত্র সংশয়। সাকিব যে ইতোমধ্যেই ভেবেও রেখেছেন কি করবেন, সেটাও তাই অনুমান করাই যায়। ক্রিকেটপাগল এই জাতি আনন্দে ভাসে একটুতেই, আবার ঘৃণাও করতে জানে মুহুর্তেই। সাকিব নিজেও তা খুব ভালোমতো জানেন। সাউথ আফ্রিকা এবং শ্রীলঙ্কা সিরিজে খেললে সাকিব হয়তো জাতীয় হিরো হবেন, না খেললে আরও একবার পরিণত হবেন জাতীয় ভিলেনে। তাতে অবশ্য এখন আর তাঁর খুব বেশী যায় আসে না।
“সময় এসেছে আমার টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করার। আমি টেস্ট খেলব কি খেলব না। আর যদি খেলি তাহলেও কিভাবে খেলব। আমি বলছি না আমি টেস্ট থেকে অবসরই নিয়ে নেব। এমনও হতে পারে আমি টি-টোয়েন্টি খেলা ছেড়ে দিলাম ২০২২ বিশ্বকাপের পর; শুধু টেস্ট ও ওয়ানডে খেললাম। তবে তিন ফরম্যাটে একসাথে খেলা অসম্ভবের কাছাকাছি। আমার কাছে আর কোন পথ খোলা নেই।”
এইতো কদিন আগেই দেশের শীর্ষস্থানীয় এক টেলিভিশন চ্যানেলে সাকিব এভাবেই বলেছিলেন। সাকিব যদি আইপিএল খেলতে চান, আর সেই চাওয়ার পথে যদি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সাউথ আফ্রিকা এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ তাহলে সাকিব হয়তো টেস্ট ক্রিকেটটাকেই বিদায় জানিয়ে দিবেন। অথবা, যেকোন একটা সিরিজ থেকে নিবেন বিশ্রাম। তাতেও অবশ্য তাঁর ভিলেন হওয়া আটকাবে না।
ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় এসে যে সাকিব আর এতোকিছু নিয়ে ভাবেন না সেটাও স্পষ্ট করেছিলেন উৎপল শুভ্রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। সেখানে বলা কথাগুলোই নাহয় আরও একবার দেখে নেওয়া যাক।
“আমি চাই শান্তিতে থাকতে, ফোকাসে না আসতে, দূরে থাকতে। আমি জানি, আমাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ সবসময় থাকবে না। আর সুবিধা হয়েছে কি, সাসপেন্ড হয়েছি দুইবার। যা আমাকে আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, কী হতে পারে।”
“এমন না যে, ক্রিকেটটা এনজয় করি না। এনজয় করি, পারফর্মও করতে চাই…আবার কমিটমেন্টের পয়েন্টটাও ঠিক আছে। ক্রিকেটই টপ প্রায়োরিটি কি না, বলতে পারব না! তবে যখন খেলার ভেতরে ঢুকি, যদি চ্যালেঞ্জ আসে, সেটা ওভারকাম করার একটা তাড়না কিন্তু থাকেই।”
সাকিবের কথাতেই স্পষ্ট তাঁর যে ক্রিকেটে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা বদলেছে। ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসে সাকিব যদি দেশের খেলাকে উপেক্ষা করে আইপিএলে যান, তাতেও হয়ত তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না। আজকাল যে সাকিব পরিবারকেই দেন সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য, টাকাটাও নিশ্চিতভাবেই একটা ফ্যাক্ট। আবার সাকিব আইপিএল উপেক্ষা করে দেশের হয়ে খেলতে গেলেও বদলাবে না দৃশ্যপট।

দেশের জন্য সাকিব কতটা নিবেদিত প্রাণ তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠলেও সাকিব যে কখনোই এসবের তোয়াক্কা করেননি সেটাও বহুবার বলেছেন। খেলে গেছেন, সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছেন, দেশের নামটা করেছেন আলোকিত। সাকিবের হাজারও অর্জন, তাঁকে নিয়ে সাজানো শত শত রুপকথার সবই তো সত্য। এবার নাহয় আরও একটা রুপকথা সত্য হোক; সাকিব থেকে যাক, খেলুক দেশের হয়ে আরও একবার। যেই সাউথ আফ্রিকা সিরিজে বিশ্রাম নিয়ে পাঁচ বছর আগে হয়েছেন সমালোচিত, সেই সাউথ আফ্রিকাতেই সাকিব ফিরুক ২০০৮ সালের সেই পুরোনো সাকিব হয়ে।

অথবা, সাকিব আরও একবার বেছে নিক সমালোচনার পথটাই। সেই পথেও সাকিবেই দৃষ্টি থাকবে কোটি কোটি চোখের! সিদ্ধান্তটা সাকিবকেই নিতে হবে। কঠিন সব চ্যালেঞ্জ জিতেই হয়েছেন বিশ্বসেরা। বিশ্বসেরা হয়ে যাওয়ার পর তাদের জীবনে আসা চ্যালেঞ্জগুলোও বোধহয় এমন কঠিন হয়। কি করবেন সাকিব সেটা সময়ই বলে দিবে। যেটাই করুক না কেন, সেটা যে তাঁর ক্যারিয়ারে অনেক বড় প্রভাব ফেলবে, তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা গল্পে পরিণত হবে সেটা অনুমান করাই যায়। সাকিব নাহয় তাঁর জীবনের সেরা গল্পটা লিখুক নিজ হাতেই। তাঁকে নিয়ে যে কখনোই উপসংহারে আসা যায় না, কল্পনা করা যায় মাত্র…